হাদাইসের প্রকারভেদ
হাদীসের প্রকারভেদ (পর্ব ১)
সকল প্রসংসা সেই মহান আল্লাহ্ র জন্য যিনি এক ও অদ্বিতীয়। যিনি ব্যতিত আমাদের কোন সাহায্যকারী নাই। আমরা একমাত্র তারই ইবাদত করি। দূরুদ ও সালাম সেই রাসূল (সাঃ) এর প্রতি, তার পরিবার ও সাহাবীগণের প্রতি, যার আদর্শের সত্যিকারের অনুসরন ও অনুকরনের মাধ্যমেই শুধুমাত্র ইহকাল ও পরকালে মুক্তি লাভ সম্ভব।
ইসলামী জীবন বিধানের মূল ভিত্তি হচ্ছে কোরআন ও হাদিস। কোরআন মানুষের জীবন ব্যবস্থার মৌলিক নীতি পেশ করে, আর হাদিস থেকে পাওয়া যায় সেই মূলনীতি বাস্তবায়নের কার্যকর পন্থা। কোরআন যদি ইসলামের প্রদীপ হয়ে থাকে তাহলে হাদিস হচ্ছে সেই প্রদীপের বিচ্ছুরিত আলো। আলোহীন প্রদীপ যেমন অবাস্তব তেমনি হাদীসকে অগ্রাহ্য করে শুধু কোরআন অর্থহীন। তাই ইসলামকে বুঝতে হলে কোরআন ও হাদীসকে শক্ত করে ধরতে হবে ।
হাদীস কি?
হাদীস আরবী শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ কথা, বানী, সংবাদ, উপদেশ ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় হাদীস হচ্ছে- রাসূল (সঃ) এর যে কথা, কাজের বিবরণ কিংবা কথা ও কাজের সমর্থন ও অনুমোদন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্র হতে প্রমানিত ইসলামী পরিভাষায় তাকে হাদীস বলে।
পারিভাষিক অর্থে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) বলেন - ”রাসূল (সঃ) এর কথা, কাজ ও মৌন সম্মতিই হল হাদীস।”
আর একটু ব্যাপক অর্থে মুফতি আমীমুল ইহসান (রঃ) বলেন - ”সাধারন অর্থে রাসূল (সঃ), সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীনদের উক্তি এবং রাসূল (সঃ) এর কাজ ও মৌন সম্মতিকে হাদীস বলে।”
সুন্নত ও হাদীস বলতে কি বুঝায়?
হাদীসের আরেকটি নাম হচ্ছে সুন্নাত। ‘সুন্নাত’ শব্দের অর্থ হলো চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। হাদীস শব্দের সমর্থক রুপে সুন্নাত শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ইমাম রাগেব এর মতে - ’সুন্নাতুন্নবী’বলতে সে পথ ও রীতি পদ্ধতি বোঝায়, যা রাসূল (সঃ) বাছাই করে নিতেন এবং অবলম্বন করে চলতেন।
আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী (রঃ) বলেন - রাসূল (সঃ) এর কাছ থেকে যাকিছু (জীবন চলার পদ্ধতি) এসেছে তাই হল সুন্নাত।
রাসূল (সঃ) কে যেই ’মানবতার আদর্শ ’ অনুসরন করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তা হাদীস থেকে জানা যায়। কারন রাসূল (সঃ) নিজের থেকে কিছু বলতেন না, তিনি যা বলতেন তা আল্লাহর নির্দেশেই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন - ”সে কখনো নিজের থেকে কোন কথা বলে না, বরং তা হচ্ছে ‘ওহী’ যা (তার কাছে ) পাঠানো হয়।”(সূরা নাজম, আয়াত : ৩,৪)
এ কারনে মুহাদ্দিসগণ ‘হাদীস’ও ‘সুন্নাত’কে একই অর্থে ব্যবহার করেছেন।
আল্লামা আব্দুল আজীজ আল হানাফী লিখেছেন - ‘সুন্নাত’শব্দটি রাসূল (সঃ) এর কথা ও কাজ বুঝায় এবং ইহা রাসূল ও সাহাবীদের অনুসৃত বাস্তব কর্মনীতি অর্থেও ব্যবহৃত হয়। রাসূল (সঃ) যে সকল কাজ করতেন ও বলতেন তা হাদীস ও সুন্নাত। আর তার সামনে সাহাবীরা যে সকল কাজ করতেন এবং যেগুলোতে রাসূল (সঃ) এর অনুমোদন ও সমর্থন থাকতো বা যেগুলোতে তিনি প্রতিবাদ করেননি সেগুলো ও হাদীস নামে অভিহিত করা হয়, কিন্ত সেগুলোকে সুন্নাত বলা হয় না। হাদীস ও তাফসীরের কিতাব সমূহে সাহাবী, তাবেয়ীনদের কথা ও কাজকেও হাদীসের পর্যায়ে গন্য করা হয়েছে। যদিও এসবের পারিভাষিক নাম বিভিন্ন। কোন কোন মুহাদ্দিস সাহাবী ও তাবেয়ীনদের কথা ও কাজ কে ‘আসার’বলে অভিহিত করেছেন।
হাদীসের প্রকারভেদ:
প্রাথমিকভাবে হাদীসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ১. কাওলী হাদীস ২. ফে’লী হাদীস ৩. তাকরীরী হাদীস। সকল হাদীসই এই তিন ভাগে বিভক্ত। এখন জেনে নিই এই তিন প্রকারের হাদিস কাকে বলে।
১। কাওলী হাদীস: রাসূল (সঃ) এর কথামূলক বা বিবৃতি মূলক হাদিসকে কাওলী হাদীস বলে। অর্থাৎ কোন বিষয়ে রাসূল (সঃ) নিজে যা বলেছেন সেটাই হচ্ছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রথম উৎস। এটাই কাওলী হাদীস।
যেমন: “হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসূল (সঃ) বলেছেন : ফাসিক ব্যক্তির প্রসংসা ও স্তুতি করা হলে আল্লাহতায়ালা অসন্তষ্ট ও ক্রুদ্ধ হন এবং এ কারনে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে।”(বায়হাকী)
”আবু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেন-মানুষ স্বীয় পরিবার পরিজনের জন্য পূন্যের আশায় যখন ব্যায় করে সেটা তখন তার জন্য সদাকাহ হয়ে যায়।” (বুখারী , ১ম খন্ড, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদীস নং ; ৫৫)
২। ফে’লী হাদীস: কর্মমূলক হাদীস । রাসূল (সঃ) এর কাজ কর্ম চরিত্র ও আচার - আচরনের মধ্য দিয়েই ইসলামের যাবতীয় বিধি বিধান ও রীতিনীতি পরিস্ফুট হয়েছে। ফলে তার সকল কাজই শরীয়তের ভিত্তি হিসেবে গন্য। অতএব যে সকল হাদীসে রাসূল (সঃ) এর কর্মের বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে তাকে ফে’লী হাদীস বলে। যেমন:
“ আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : রাসূল (সাঃ) জুতা পরা , চুল আচড়ানো এবং পবিত্রতা অর্জন করা তথা প্রত্যেক কাজই ডান দিক থেকে আরম্ভ করতে পছন্দ করতেন ।” ( বুখারী, ১ম খন্ড,তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদীস নং: ১৬৮)
৩। তাকরিরী হাদীস: রাসূল (সাঃ) হতে অনুমোদন ও সমর্থন প্রাপ্ত কথা ও কাজ অর্থাৎ সাহাবীদের যে সকল কথা ও কাজে রাসূল (সাঃ) এর সম্মতি পাওয়া যায় বা তিনি প্রতিবাদ বা নিষেধ করেন নাই এবং যা হতে শরীয়তের দৃষ্টি ভঙ্গি জানতে পারা যায়, সেই সকল ঘটনা ও কাজের উল্লেখিত হাদীসকে তাকরিরী বা সমর্থনমূলক হাদীস বলে। যেমন:
“আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন : আমরা রাসূল (সাঃ) এর সাথে সালাত আদায় করতাম । আমাদের কেউ কেউ গরমের কারণে নিজ কাপরের উপর সিজদা করত ।” ( বুখারী , ১ম খন্ড, তাওহীদ পাবলিকেশন্স , হাদীস নং: ৩৮৫)
হাদীসে কুদসী কি?
হাদীসের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হাদীসে কুদসী। এ হাদীসের মুল বক্তব্য সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত। কুদসী শব্দটি আরবী ‘কুদুস’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ পবিত্র, মহান। আল্লাহর আর একটি নাম ‘কুদ্দুস ’ মহান, পবিত্র।
আল্লাহ তার নবীকে ‘ইলহাম’ কিংবা স্বপ্নযোগে যা জানাতেন নবীজী নিজ ভাষায় তা বর্ণনা করতেন। একে বলা হয় হাদীসে কুদসী।
আল্লামা আবুল বাকা তার ‘কুল্লিয়াত’ বইতে লিখেছেন: ‘কুরআনের শব্দ, ভাষা, অর্থ, ভাব ও কথা সবই আল্লাহর কাছ থেকে সুস্পষ্ট ওহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ, আর হাদীসে কুদসীর শব্দ ও ভাষা রাসুলের। কিন্ত এর অর্থ, ভাব ও কথা আল্লাহর কাছ হতে রাসূল (সাঃ) ইলহাম কিংবা স্বপ্নযোগে পেয়েছেন।
কুরআন ও হাদীসে কুদসীর মধ্যে পার্থক্য :
১। কুরআন শরীফ জিবরাইল (আঃ) এর মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে রাসূল (সাঃ) এর কাছে নাজিল হয়েছে এবং তার ভাষা ও শব্দ নিশ্চিতভাবে লাওহে মাহফু’জ থেকে অবতীর্ন হয়েছে।
অন্য দিকে হাদীসে কুদসীর মূল বক্তব্য আল্লাহর নিকট থেকে ইলহাম কিংবা স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত এবং তার ভাষা রাসূল (সাঃ) এর নিজস্ব।
২। সালাতে কুরআন তেলাওয়াত করতে হয় । কুরআন ছাড়া সালাত সহীহ হয় না।
পক্ষান্তরে, সালাতে হাদীসে কুদসী পড়া যাবেনা। এতে সালাত হবেনা।
৩। হায়েয নেফাস সম্পন্না নারীর অপবিত্র অবস্থায় কুরআন ধরা হারাম কিন্ত হাদীসে কুদসী অপবিত্র অবস্থায় স্পশ কারত পারবে।
৪। কুরআন শরীফ আল্লাহর একটি মুযেজা, কিন্ত হাদীসে কুদসী কোন মুযেজা নয়।
৫। কুরআন অমান্য করলে কাফির হয়ে যায় কিন্তু হাদীসে কুদসী অমান্য কারলে গুনাহ হবে কিন্ত কাফের হবে না।
কিছু হাদীসে কুদসীর উদাহরণ:
১। আবু হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূল (সাঃ) বলেছেন : মালাকগণ পালা বদল করে তোমাদের মাঝে আগমন করেন , একদল দিনে আর একদল রাতে। আসর ও ফজরের সালাতে সবাই একত্রিত হন। অতঃপর তোমাদের মাঝে রাতে যাপনকারী দলটি উঠে যান। তখন তাদের প্রতিপালক তাদের জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দাদের কোন অবস্থায় রেখে আসলে? অবশ্য তিনি নিজেই তাদের ব্যপারে সর্বাধিক অবগত। উত্তরে তারা বলেন, আমরা তাদের সালাতে রেখে এসেছি, আর আমরা যখন তাদের নিকট গিয়েছিলাম তখনও তারা সালাত আদায়রত অবস্থায় ছিলেন।” (বুখারী, ১ম খন্ড, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদীস নং: ৫৫৫)
২। আবু হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন: মহামহিম আল্লাহতাআলা প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়ংশ অবশিষ্ট থাকা কালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষনা করতে থাকেন : কে আছে এমন যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব । কে আছে এমন আমার নিকট চাইবে ? আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদীস নং : ১১৪৫)
হাদীসের সনদ ভিত্তিক প্রকারভেদ:
হাদিসের মূল কথাটুকু যে সুত্র পরস্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌছেছে তাকে ‘সনদ’বলে। এতে হাদীস বর্ণনাকারীর নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে। আর হাদীসের মূলকথা ও উহার শব্দ সমষ্টিকে ‘মতন’ বলে।
রাবী বা হাদীস বর্ণনাকারীদের সনদের দিক থেকে হাদীস তিন প্রকার: ১। মারফু হাদীস ২। মাওকুফ হাদীস ও ৩। মাকতু হাদীস
১। মারফু হাদীস : যে হাদীসের সনদ (বর্ণনা পরস্পরা) রাসূল (সাঃ) পর্যন্ত পৌছেছে, অর্থাৎ যে সনদের ধারাবাহিকতা রাসূল (সাঃ) থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে এবং মাঝে কোন রাবী বা হাদীস বর্ণনাকারীর নাম বাদ পড়েনি তাকে মারফু হাদীস বলে ।
যেমন: যে সকল হাদীস এভাবে বর্ণিত হয়েছে - ”রাসূল (সাঃ) বলেছেন : ”, ” আমি রাসূল (সাঃ) কে এভাবে করতে দেখেছি” বা কোন সাহাবী বলেছেন “আমি রাসূল (সাঃ) এর উপস্থিতিতে এই কাজটি করেছি কিন্তু তিনি ইহার প্রতিবাদ করেন নাই” এভাবে বর্ণিত হাদীসগুলোকে মারফু হাদীস বলে ।
২। মাওকুফ হাদীস : যে হাদীসের বর্ণনাসূত্র ঊর্দ্ধদিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌছেছে অর্থাৎ যে সনদ সূত্রে কোন সাহাবীর কাজ, কথা বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে তাকে মাওকুফ হাদীস বলে। এর অপর নাম আসার।
যেমন: ”উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত, জনৈক ইয়াহুদী তাকে বলল : হে আমিরুল মু’মিনীন! আপনাদের কিতাবে একটি আয়াত আছে যা আপনারা পাঠ করে থাকেন, তা যদি আমাদের ইয়াহুদী জাতির উপর অবতীর্ন হতো, তবে অবশ্যই আমরা সে দিনকে খুশীর দিন হিসেবে পালন করতাম। তিনি বললেন, কোন আয়াত? সে বললো:”আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম” (সূরা মায়িদাহ্ ৫/৩)। উমর (রাঃ) বললেন এটি যে দিনে এবং যে স্থানে নবী (সাঃ) এর উপর নাজিল হয়েছিল তা আমরা জানি, তিনি সে দিন আরাফায় দাড়িয়ে ছিলেন আর সেটি ছিল জুমআর দিন। ”(বুখারী ১ম খন্ড, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদীস নং : ৪৫)।
৩। মাকতু হাদীস : যে হাদীসের সনদ কোন তাবেয়ীন পর্যন্ত পৌছেছে তাকে মাকতু হাদীস বলে।
যেমন: ”আমর ইবনুল মাইমূন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি জাহিলীয়্যাতের যুগে দেখেছি একটি বানরী ব্যাভীচার করার কারণে অনেকগুলো বানর একত্র হয়ে প্রস্তর নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করলো। আমিও তাদের সাথে প্রস্তর নিক্ষেপ করলাম।” (বুখারী, ৩য় খন্ড, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদীস নং: ৩৮৪৯)
রাবীদের ধারাবাহিকতার হিসেবে হাদীসের শ্রেনীভাগ:
১। মুত্তাসিল হাদীস: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পূর্ণরুপে রক্ষিত আছে, কোন স্তরেই কোন রাবীর নাম বাদ পড়েনি তাকে মুত্তাসিল হাদীস বলে।
২। মুনকাতি হাদীস: যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি মাঝখানে কোন এক স্তরে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে তাকে মুনকাতি হাদিস বলে। আর এই বাদ পড়াকে বলা হয় ইনকিতা।
৩। মুয়াল্লাক হাদীস : সনদের ইনকিতা প্রথমদিকে হলে অর্থাৎ সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়লে তাকে মুয়াল্লাক হাদীস বলে।
৪। মুরসাল হাদীস : যে হাদীসের ইনকিতা শেষের দিকে রয়েছে অর্থাৎ সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে এবং তাবেঈ সরাসরি রাসূল (সাঃ) এর নাম উল্লেখ করে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাকে মুরসাল হাদীস বলে।
ত্রুটিযুক্ত বর্ণনার হাদীসের প্রকার:
শা’য হাদীস: যে হাদীসের বর্ণনাকারী বিশ্বস্ত কিন্ত তার চেয়ে অধিক বিশ্বস্ত রাবীর বর্ণনার বিপরীত তাকে শা’য হাদীস বলে।
মুয়াল্লাম হাদীস: যে হাদীসের বর্ণনা সূত্রে এমন সূক্ষ ত্রুটি থাকে যা কেবল হাদীস শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞরাই পার্থক্য করতে পারেন তাকে মুয়াল্লাম হাদীস বলে।
রাবীদের গুন ও যোগ্যতার বিচাওে হাদীসের প্রকারভেদ:
সহীহ হাদীস: যে মুত্তাসিল হাদীসের সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ আদালত ও যাবত গুন সম্পন্ন এবং হাদীসটি যাবতীয় দোষত্রুটি মুক্ত, তাকে সহীহ হাদীস বলে।
হাসান হাদীস: যে হাদীসের কোন রাবীর যাবত গুনের পরিপূর্ণতার অভাব রয়েছে তাকে হাসান হাদীস বলে।
ফিকহবিদগন সাধারণত সহীহ ও হাসান হাদীসের ভিত্তিতে আইন প্রনয়ন করেন।
যঈফ হাদীস: যে হাদীসের কোন রাবী হাসান হাদীসের রাবীর গুনসম্পন্ন নয় তাকে যঈফ হাদীস বলে। রাবীর দুর্বলতার কারনেই হাদীসটিকে দূর্বল বলা হয়, অন্যথায় (নাউযুবিল্লাহ) মহানবী (সাঃ) এর কোন কথাই যঈফ নয়।
মওযূ হাদীস : যে হাদীসে রাবী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূল (সাঃ) এর নামে মিথ্যা কথা রচনা করেছেন বলে প্রমানিত হয়েছে তার বর্ণিত হাদীসকে মাওযু হাদীস বলে। এরুপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস গ্রহনযোগ্য নয় ।
মাতরূক হাদীস: যে হাদীসের রাবী হাদীসের ক্ষেত্রে নয়; বরং সাধারন কাজ কর্মে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহন করে বলে খ্যাত, তার বর্ণিত হাদীসকে মাতরুক হাদীস বলে। এরুপ ব্যাক্তির বর্ণিত হাদীসও পরিত্যাজ্য ।
মুবহাম হাদীস: যে হাদীসের রাবীর উত্তমরুপে পরিচয় পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে তার দোষ গুন বিচার করা যেতে পারে, এরুপ রাবীর বর্ণিত হাদীসকে মুবহাম হাদীস বলে। এই ব্যাক্তি সাহাবী না হলে তার হাদীস ও গ্রহনযোগ্য নয় ।
রাবীর সংখ্যা হিসেবে হাদীসের প্রকারভেদ :
মুতাওয়াতির হাদীস: যে সহীহ হাদীস প্রত্যেক যুগে এতো অধিক সংখ্যক লোকে বর্ণনা করেছেন, যাদের পক্ষে মিথ্যার জন্য দলবদ্ধ হওয়া সাধারণত অসম্ভব তাকে মুতাওয়াতির হাদীস বলে। এই ধরনের হাদীস দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান লাভ হয়।
খবরে ওয়াহিদ : প্রত্যেক যুগে এক, দুই বা তিন জন রাবী কতৃক বর্ণিত হাদীসকে খবরে ওয়াহিদ বা আখবারুল আহাদ বলে। এই হাদীস তিন প্রকার-
(ক) মাশহূর হাদীস: যে সহীহ হাদীসে প্রত্যেক যুগে অন্তত পক্ষে তিন জন রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে মাশহূর হাদীস বলে।
(খ) আযীয হাদীস: যে সহীহ হাদীস প্রত্যেক যুগে অন্তত দুই জন রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে আযীয হাদীস বলে।
(গ) গরীব হাদীস: যে সহীহ হাদীস কোন যুগে একজন মাত্র রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে গরীব হাদীস বলে।
সাহাবীদের বর্ণনাকৃত হাদীসের সংখ্যা:
রাসূল (সাঃ) এর ওফাতের সময় প্রায় এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার মতান্তরে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সাহাবী ছিলো । যারা সরাসরি রাসূল (সাঃ) এর কাছ থেকে হাদীস শুনেছিলেন।
রাসূল (সাঃ) এর কাছ থেকে কিছু না কিছু শনেছেন এমন সাহাবীদের সংখ্যা লক্ষাধিক। কিন্তু আল্লামা যাহরীর মতে যেসব সাহাবী গননাযোগ্য ও গ্রহনযোগ্য হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের সংখ্যা একশ পাঁচ জনের বেশি নয়।
যদিও মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালীসি দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষ ভাগে সংকলিত একটি হাদীস গ্রন্থ তে প্রায় আড়াইশো সাহাবী হতে বর্ণিত হাদীস আসে। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মত হচ্ছে ২৮ জন সাহাবী সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। আর অনেক সাহাবী ছিলেন যারা ৪০ এর কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন।
সংখ্যার ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনাকারী সমস্ত সাহাবীদেরকে ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১। যাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১০০০ বা তার অধিক।
২। যাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫০০ বা তার অধিক।
৩। যাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১০০ বা তার অধিক।
৪। যাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৪০ বা তার অধিক কিন্ত ১০০ এর কম ।
৫। এবং যাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৪০ বা তার কম।
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে ১ম ভাগের যে সকল সাহাবীরা রয়েছেন তাদের সংখ্যা খুবই কম। মাত্র ৭ জন।
তারা হলেন :
১। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ), বর্ণনাকৃত হাদীস ৫৩৭৪ টি।
২। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), বর্ণনাকৃত হাদীস ২৬৬০ টি।
৩। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ), বর্ণনাকৃত হাদীস ২২১০ টি ।
৪।হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ), বর্ণনাকৃত হাদীস ১৬৩০ টি।
৫। হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ), বর্ণনাকৃত হাদীস ১৫৬০ টি।
৬। হযরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ), বর্ণনাকৃত হাদীস ১২৮৬ টি।
৭। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ), বর্ণনাকৃত হাদীস ১১৭০ টি।
(চলবে...)
আল্লাহ আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করুণ।
আমীন।
-- সংকলিত
তথ্য সূত্র:
১. হাদীস সংকলনের ইতিহাস ---- মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম
২. বুখারী শরীফ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স)
৩. মুসলিম শরীফ (ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)
৪. বিষয় ভিত্তিক কোরআন ও হাদীস সংকলন (পিস্ পাবলিকেশন)
Comments
Post a Comment